“ক্যান্সার” শব্দটি বেশিরভাগ লোকের কাছেই একটি ভীতিকর শব্দ। তবে নারীদের ক্ষেত্রে “স্তন (ব্রেস্ট) ক্যান্সার” শব্দটি আরও বেশি ভীতিকর হতে পারে, কেননা এটি সরাসরি নারীর দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট যা মূলত তাদের নারীত্বের প্রকাশ ঘটায়। অবশ্য, পুরুষরাও ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে, যদিও নারীদের ক্ষেত্রে প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরিসংখ্যানের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার জনে কেবলমাত্র একজনের ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্তন লিম্ফ গ্ল্যান্ড এবং লাঙ্গস (ফুসফুস)-এর খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায় এধরণের ক্যান্সার আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতো। তবে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে এধরণের ক্যান্সার থেকে মুক্তি লাভের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে, কারণ এসকল কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের তাদের নিজেদের স্তনের স্ব-পরীক্ষা করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। 40 বছর বা এর অধিক বয়সী মহিলাদের (অথবা পারিবারিক ইতিহাস আছে এমন 30 বছর বয়সী নারীদের তাদের রজোবন্ধের পূর্বে) ক্ষেত্রে এরকমটা লক্ষ্য করা যায়, যারা কিনা প্রতিনিয়ত ম্যামোগ্রাম বা আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বিগত 20 বছরে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে (1996 সালে প্রতি 100,000 নারীদের মধ্যে মৃত্যু হার ছিল 29.4, 2016 সালে কমে দাঁড়িয়েছে 20.0)।
বর্তমানে পাঁচ বছর সময়ের জন্য স্তন ক্যান্সারের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার মানেই হল আপনি নিজেকে একজন ক্যান্সার যোদ্ধা মনে করতে পারবেন। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার হার শতকরা প্রায় 89.9 ভাগ, যা অন্য সকল ধরণের ক্যান্সার রোগীর থেকে সবথেকে বেশি (2009 - 2015 সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী)। বর্তমানে ম্যাসটেক্টোমি (সম্পূর্ণ স্তনের অপসারণ)-এর পরিবর্তে বর্তমানে লাম্পেক্টোমি (স্তনের কিছু অংশ বিশেষ অপসারণ) প্রধান চিকিৎসা হিসেবে প্রচলিত আছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো ম্যাসটেক্টোমির প্রয়োজন পরে। যদি কোনো রোগীর স্তন নিতান্তই অপসারণ করার প্রয়োজন পরে, তাহলে সেক্ষেত্রে তার কাছে প্রোসথেসিস (কৃত্রিম স্তন) বা টিস্যু পুনর্গঠনের মতো সমাধান রয়েছে। স্তন ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপিরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কেননা চিকিৎসা ক্ষেত্রে আধুনিকতার মাধ্যমে এসকল চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে।
স্তন ক্যান্সার কোষ কিছু হরমোন এবং প্রোটিনের প্রতি বেশ প্রতিক্রিয়াশীল এবং এই আবিষ্কারটিই মৃত্যু হার কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এসব হরমোন এবং প্রোটিন অবরুদ্ধ করা বা এদের কার্যকলাপে বাধা দেয়ার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করে এমন ঔষধ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু ক্যান্সার কোষের বৈশিষ্ট্য ও প্রতিক্রিয়াশীলতা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং ভিন্ন ভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে তা ভিন্ন রকম হতে পারে। ফলে উপযুক্ত ঔষধটি বেছে নেয়ার জন্য দরকার সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
ক্যান্সার কোষে হরমোন রিসেপ্টরের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পরীক্ষা। যেসকল ক্যান্সার কোষে হরমোন রিসেপ্টর (HR+) রয়েছে সেগুলো ঔষধের প্রতি সংবেদনশীল, ফলে সেসব কোষ হরমোন দ্বারা উদ্দীপিত হতে পারে না।
হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপ্টর-2 (HER2)-এর উপস্থিতি নিশ্চিত করার পরীক্ষা। যেসকল ক্যান্সার কোষে এই রিসেপ্টরটি (HER2+) রয়েছে সেসকল কোষ অন্য যেকোনো রিসেপ্টরবিহীন কোষের তুলনায় অত্যন্ত দ্রুত হারে বিস্তার লাভ করতে থাকে।
চিকিৎসক কোন চিকিৎসাটি নির্বাচন করবেন সেটি নির্ধারণ করার জন্য উভয় বিষয়কেই প্রাধান্য দেন। উদাহরণস্বরূপ, কোষগুলো যদি HR পজিটিভ হয় কিন্তু HER2 নেগেটিভ হয় (HR+/HER2-) যা খুব বেশি স্বাভাবিক বা এতে ক্যান্সার ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকবে, সেক্ষেত্রে উক্ত রোগীর জন্য হরমোন থেরাপি কার্যকর হবে। আবার যদি HR নেগেটিভ হয় কিন্তু HER2 পজিটিভ হয় (HR-/HER2+), তাহলে সেক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি অকার্যকর হবে। পরিবর্তে HER2-উপযোগী থেরাপি গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করা হবে।
যেসকল রোগীর ক্ষেত্রে তিনটিই নেগেটিভ – অর্থাৎ যাদের HR নেগেটিভ এবং HER2 নেগেটিভ ক্যান্সার কোষ রয়েছে – পূর্বে তাদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালের কিছু উন্নতির মাধ্যমে টার্গেটেড থেরাপি অনেকটাই আধুনিকতা লাভ করেছে। যেকোনো ধরণের ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে বর্তমানে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থাৎ, বলা যায় যে, বর্তমানে দুরারোগ্য ক্যান্সারের কাছে হেরে যাওয়ার চেয়ে এর থেকে মুক্তি পেয়ে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বর্তমান সময়ের চিকিৎসা যতোটাই আধুনিক ও উন্নত হোক না কেন, ক্যান্সার যতো দ্রুত সনাক্ত করা যাবে এর চিকিৎসা ততোটাই সহজ হয়ে যাবে। নারীদের প্রতিনিয়ত নিজেদের স্তনের স্ব-পরীক্ষা করা উচিৎ। এই পরীক্ষাটি করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে তাদের মাসিক শেষ হওয়ার সাত দিন পর। স্তন, স্তনবৃন্তের আশেপাশে বা স্তনের ত্বকে যদি কোনো ধরণের অস্বাভাবিক লাম্প পরিলক্ষিত হয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
40 বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, স্তনের স্ব-পরীক্ষাগুলো যেকোনো বয়সেই আপনি করতে পারেন। 40 বছর বয়সে মূলত স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। সেকারণে রোগীর পরিবারে পূর্বে কারো এধরণের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা থাকুক বা না থাকুক, একটি ম্যামোগ্রাম টেস্ট করিয়ে ফেলা উচিৎ।
পরিশেষে, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়ার মাধ্যমে প্রথম থেকেই ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়: হতে পারে সেটি নিয়মিত ব্যায়াম করা, দেহের ওজন ঠিক রাখা, শারীরিকভাবে কর্মক্ষম থাকা, অথবা অ্যালকোহল সেবন এড়িয়ে চলা। কিন্তু, রোগী যদি ইতোমধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তার নিজের মনোবল এবং কাছের মানুষদের উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে তার ক্যান্সার চিকিৎসার পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। ইতিবাচক মন-মানসিকতা এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকাই নিজের পরিবার ও কাছের মানুষদের সাথে থাকার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে।
For more information please contact: